ভাঙতে ভাঙতে রাজবাড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে এল সুড়ঙ্গ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 02-12-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

বাড়িটি বানিয়েছিলেন দিঘাপতিয়ার রাজা হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ছেলে সন্দীপ কুমার রায়। বাড়ির দুই পাশে দুটি একতলা ভবন। সামনে একটি নাগলিঙ্গম ফুলের গাছ। পেছনে একটি দোতলা ভবন। সরকারি কাগজে এটি এখন অর্পিত সম্পত্তি। স্থাপনাটি জরাজীর্ণ হওয়ায় নিলামে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয় প্রশাসন। সেই বাড়ি ভাঙতে গিয়ে নিচতলা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি সুড়ঙ্গ। সেখান থেকে বের হচ্ছে পানি।

‘ঐতিহাসিক’ এই বাড়িটির অবস্থান রাজশাহী নগরের দরগাপাড়া মৌজায়। ভবনটির প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য ছিল কি না, যাচাই না করেই ভাঙার জন্য নিলামে তুলে বিক্রি করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় ইতিহাসবিদেরা। তাঁরা বলছেন, এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল।

 

 

বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দরগাপাড়া মৌজায় ৫২৪ খতিয়ানের এই জমির দাগ নম্বর ৪৭। শ্রেণি হিসেবে লেখা আছে, ‘সিভিল ডিভিশন অফিস’। মালিকের ঠিকানায় ‘দিঘাপতিয়া স্টেট, বলিহার, থানা– নাটোর’ লেখা আছে। ১৯৮১ সালে বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়। যদিও সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের পর কোনো সম্পত্তিকে অর্পিত ঘোষণা করা যাবে না। এরপর কীভাবে ১৯৮১ সালে বাড়িটিকে অর্পিত ঘোষণা করা হয়েছে, তা রহস্যজনক।

কবি ও গবেষক তসিকুল ইসলাম জানান, রাজপরিবার চলে যাওয়ার পর বাড়িটি পড়ে ছিল। স্বাধীনতার পর ভাষাসৈনিক মনোয়ারা রহমানকে বাড়িটি ইজারা দেয় সরকার। তিনি বাড়িতে ‘মহিলা কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি সংগঠন চালাতেন। ২০০৯ সালে মনোয়ারা রহমান মারা যাওয়ার পর বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

 

জনশ্রুতি রয়েছে, মহারানি হেমন্তকুমারী (১৮৬৯-১৯৪২) পুঠিয়া থেকে রাজশাহী শহরে এলে এই বাড়িতে থাকতেন। রাজশাহীর একটি কলেজের শিক্ষক আখতার বানু ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতে যাতায়াত করেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, বাড়িতে ঢুকতেই সামনে পড়ে একটি নাগলিঙ্গম ফুলের গাছ। সেটি এখনো আছে। ডান ও বাঁ পাশে দুটি একতলা ভবন। তার ঠিক উত্তর পাশে দোতলা ভবন। একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কাঠের সিঁড়ি ছিল। আর পূর্ব পাশ দিয়ে চুন–সুরকির সরু একটি সিঁড়ি ছিল। এ ছাড়া দোতলা ভবনের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গপথে একতলা ভবনে যাওয়ার রাস্তা ছিল। ওই একতলা ভবন ভাঙতে গিয়েই সুড়ঙ্গটা উন্মুক্ত হয়ে যায়।

বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয় বলছে, মাসখানেক আগে স্থাপনাটি নিলামে বিক্রি করে দেয় জেলা প্রশাসন। নগরের দরগাপাড়া এলাকার এক ব্যক্তি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকায় সেটি কিনে নেন। ১০–১৫ দিন ধরে তিনি সেটা ভাঙতে শুরু করেন।

রাজশাহীতে একটি রাজবাড়ী ভাঙার সময় মেঝের নিচে পাওয়া গেল সুড়ঙ্গ। মঙ্গলবার দুপুরে নগরের দরগাপাড়া মহল্লায়

রাজশাহীতে একটি রাজবাড়ী ভাঙার সময় মেঝের নিচে পাওয়া গেল সুড়ঙ্গ। মঙ্গলবার দুপুরে নগরের দরগাপাড়া মহল্লায়

আজ মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, পাঁচজন শ্রমিক বাড়িটি ভাঙার কাজ করছেন। ক্রেতার ব্যবস্থাপক অপু বলেন, বাড়িটি ভাঙার পর সুড়ঙ্গ বেরিয়ে আসে। ভাঙার পর সেখান থেকে পানি বের হচ্ছে। এক সুড়ঙ্গের সঙ্গে আরেকটির সংযোগ আছে। সুড়ঙ্গের পানি শুকাতে সেচযন্ত্র বসানো হয়েছে। এক দিক থেকে পানি বের হচ্ছে, আরেক দিক থেকে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে টেনে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে আস্তে আস্তে শুকনা জায়গা বের করে তারা ভাঙার কাজ করছেন।

হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা মাহাবুব সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এমন স্থাপনা ভাঙার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীর পরতে পরতে দিঘাপতিয়ার জমিদারদের অবদান আছে। বরেন্দ্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজকুমার শরৎ কুমার রায়। রাজশাহী কলেজ ও পিএন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন তাঁর ভাই প্রমদানাথ রায়। আরেক ভাই বসন্ত কুমার রাজশাহী হাসপাতালের জন্য ৮০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। নগরের মিয়াপাড়ায় ডিজিএফআইয়ের বর্তমান কার্যালয়টি হেমেন্দ্র কুমার রায়ের বাড়ি। মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যাঁরা রাজশাহীতে ইতিহাস চর্চা করেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহিনুল ইসলাম বলেন, স্থাপনাটি খসে পড়ে যাচ্ছিল। এ জন্য ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জায়গাটি নিয়ে তাঁদের একটা পরিকল্পনা আছে। সুড়ঙ্গ বের হওয়ার কথা শুনে বলেন, তিনি সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সেখানে পাঠাচ্ছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পেলে সেটা রক্ষা করা হবে।

শেয়ার করুন