খালেদা জিয়ার নিজের মতো করেই প্রত্যাবর্তন
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 07-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

খালেদা জিয়া নিজের মতো করেই দেশে ফিরলেন। অনেকেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনকে রাজসিক বলতে চাইবেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে, গণমানুষের নেতা গণমানুষের কাছে ফিরে এলেন। তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন, সেভাবেই তাঁর চিকিৎসার বিষয়টি সম্পন্ন হলো।

তবে খালেদা জিয়ার এবারের দেশে ফেরা ভিন্ন রকমের। তিনি দেশে ফেরার পর সামগ্রিকভাবে রাজনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। আমাদের রাজনীতির আকাশে মাঝেমধ্যে অনিশ্চয়তার মেঘ এসে হানা দেয়। এখানো নানা ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। খালেদা জিয়ার পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সেই মেঘ কেটে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিই শুরু হয়েছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে। এরপর তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ফলে অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ খালেদা জিয়ার উপস্থিতি রাজনীতিতে গতি সঞ্চার করবে এবং নানা গুঞ্জন ও গুজবের অবসান ঘটাবে।

 

 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাজানো মামলায় খালেদা জিয়াকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবেই খালেদা জিয়াকে জেলে ঢুকিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল বলে বিএনপির নেতা–কর্মীরা অভিযোগ করেন। কারণ, খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পথে পরিষ্কারভাবেই বাধা সৃষ্টি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। প্রথমত, দীর্ঘদিন জেলে আটকে রেখে। দ্বিতীয়ত, তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে। যে কারণ খালেদা জিয়া বারবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এমনও হয়েছে, বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে তাঁর অস্ত্রোপচার করানো হয়েছে, কিন্তু খালেদা জিয়াকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।

শেষ পর্যন্ত গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আসে। বয়স ও রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য কমবেশি সবাই বলেছিলেন তৎকালীন সময়ে। কিন্তু শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকারকে কোনোভাবেই বোঝানো সম্ভব হয়নি। কারণ, যাঁরা সজ্ঞানে বুঝতে চান না, তাঁদের বোঝানো মুশকিলের বিষয়।

 

খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর সড়কে বিএনপি নেতা–কর্মীদের ভিড়। মঙ্গলবার সকালে

খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর সড়কে বিএনপি নেতা–কর্মীদের ভিড়। মঙ্গলবার সকালে

বরং খালেদা জিয়ার চিকিৎসাসুবিধাকে বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার বিনিময়ে খালেদা জিয়াকে নানা প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। যেমন ২০২৪–এর জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ মিলবে, রাজনীতি থেকে অবসরে চলে যেতে হবে—এ ধরনের নানা প্রস্তাব শেখ হাসিনার সরকার খালেদা জিয়াকে দিয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে।
কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই খালেদা জিয়াকে টলানো যায়নি। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের অধিকারের প্রতি খালেদা জিয়া সচেতন ছিলেন এবং সেই জায়গা থেকে তিনি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার দাবিতে অনড় ছিলেন। কোনো কিছুর বিনিময়ে তিনি বিদেশে যেতে চাননি।

এই যে নিজের অবস্থানে অনড় থাকা, সমঝোতা না করা, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া—এসবই খালেদা জিয়ার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে রাজনীতিতে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে। নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪–এর আগস্ট বিপ্লব পর্যন্ত খালেদা জিয়া দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পথ অতিক্রম করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। জেলে গেছেন দুইবার। রাজনীতিতে উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।

খালেদা জিয়া নিজেকে দলীয় গণ্ডির বাইরে নিয়ে গেছেন। তিনি এখন শুধু বিএনপির নেতা নন, সারা দেশের মানুষের নেতায় পরিণত হয়েছেন। এই যে দলীয় সীমানার বাইরে গিয়ে সারা দেশের মানুষের নেতায় পরিণত হওয়া, এটাই খালেদা জিয়ার কৃতিত্ব। দেশে ফিরবেন শুনে দেশবাসীর আগ্রহ, আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করা—এটাই খালেদা জিয়ার অর্জন। এখানেই তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে গেলেন।

খালেদা জিয়ার রাজনীতির নিজস্ব একটি ধারা আছে। এই নেতৃত্বে আছে গাম্ভীর্য, প্রজ্ঞা ও কৌশলের মিশ্রণ। ৩৬ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুই কিশোর সন্তানকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন খালেদা জিয়া। এর পরের ৪৫ বছর তিনি দেশের জন্য রাজনীতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজের নেতৃত্ব দিয়ে বাহুধারায় বিভক্ত বিএনপিকে দুইবার ব্যালটের রাজনীতিতে জয়ী করেছেন। একাধিকবার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ এসেছিল, কিন্তু তিনি দেশের বাইরে যেতে রাজি হননি।

শালীন রাজনীতি বোধ, মার্জিত আচরণ, অনমনীয়তা, আপসহীনতা, দূরদৃষ্টি ও আত্মত্যাগের মিশেলে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্র খালেদা জিয়া। রাজনীতিবিদদের জীবনে দুই ধরনের পাঠই থাকে—সফলতা ও ব্যর্থতা। আলোচনা ও সমালোচনাও থাকে। খালেদা জিয়াকে নিয়েও আলোচনা, সমালোচনা আছে।

রাজনীতিবিদেরা কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তবে খালেদা জিয়াকে কোনোভাবেই সমালোচনার কাঠামোয় আটকে রেখে অতিক্রম করা যায় না। দেশের রাজনীতিতে এক শীর্ষস্থানীয় অনবদ্য চরিত্র খালেদা জিয়া। যিনি দলের কর্মী–সমর্থকদের বাইরেও নিজস্ব ভাবমূর্তি গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে ক্ষমতার রাজনীতিতে এ দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে দুই হাতে আগলে রেখেছেন। রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া কোনো নির্বাচনেই হারেননি। কঠিন ও বিরোধী সমর্থনপুষ্ট আসন থেকেও তিনি জিতে এসেছেন। নির্বাচনের রাজনীতিতে তিনি অপরাজেয়।

 

রাজনীতির বন্ধুর পথ তিনি সফলতার সঙ্গে পার করে এসেছেন। কথিত দুর্নীতির মামলা, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ছোট সন্তানের মৃত্যু, একাকী নিঃসঙ্গ জেলজীবন, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, শারীরিক অসুখসহ নিপীড়ন, নৃশংসতার শিকার হয়েও খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের কাছে মাথা নোয়াননি। রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়ার অর্জন বিশাল, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। তবে তাঁর গাম্ভীর্যতা কেড়ে নিতে পারেনি।

এবার যখন বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন খালেদা জিয়া, সেই গাম্ভীর্য ও আপসহীনতারই প্রতিফলন দেখ গেল। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে গাড়ির মধ্যে বসে আছেন। খালেদা জিয়ার এই ছবিই বলে দেয়, শেষ পর্যন্ত নানা ধরনের চাপ মোকাবিলা করে রাজনীতির খেলায় তিনিই জিতে গেলেন। এই খেলায় ঝুঁকি ছিল। খালেদা জিয়া বরাবরই ঝুঁকি নিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত জিতে গেছেন।

মঙ্গলবার হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার গাড়ির পিছু পিছু হেঁটে এসেছেন হাজারও মানুষ। দলের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছিল, কেউ যেন গাড়ির সঙ্গে হেঁটে জনভোগান্তি সৃষ্টি না করেন। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপ করেও দলীয় নেতা–কর্মীদের আটকে রাখা যায়নি।

এটা সম্ভবও নয়। খালেদা জিয়া নিজেকে দলীয় গণ্ডির বাইরে নিয়ে গেছেন। তিনি এখন শুধু বিএনপির নেতা নন, সারা দেশের মানুষের নেতায় পরিণত হয়েছেন। এই যে দলীয় সীমানার বাইরে গিয়ে সারা দেশের মানুষের নেতায় পরিণত হওয়া, এটাই খালেদা জিয়ার কৃতিত্ব। দেশে ফিরবেন শুনে দেশবাসীর আগ্রহ, আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করা—এটাই খালেদা জিয়ার অর্জন। এখানেই তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে গেলেন।


  •  

শেয়ার করুন