তথ্যযুদ্ধ: ভারত ও পাকিস্তান কি হামলা নিয়ে সত্য বলছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 08-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

প্রতিযোগিতামূলক সংবাদ ব্রিফিং, ভিন্ন ভিন্ন দাবি এবং পরস্পরবিরোধী বর্ণনা। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে (৭ মে) পাকিস্তান ও পাকিস্তান–শাসিত কাশ্মীরে ভারতের হামলার পর দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী সম্ভাব্য যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। এর মধ্য দিয়ে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আর তা হলো তথ্য নিয়ে।

ভারতের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উভয় পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি দাবি আসতে শুরু করে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উভয় দেশই চায় নিজেদের পক্ষে জনমত গড়তে।

উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তান বলেছে, তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ভারত এখনো এ দাবির আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, তিনটি যুদ্ধবিমান ভারতশাসিত কাশ্মীরে ভূপাতিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ভারতীয় না পাকিস্তানি, তাঁরা সেটিও নিশ্চিত করেননি।

 

 

দেখে নেওয়া যাক, দুই দেশ কী কী দাবি করেছে এবং কীভাবে অতীতেও তারা পরস্পরবিরোধী তথ্য দিয়ে নিজেদের বিজয়ী হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। এমন পরস্পরবিরোধী তথ্যে সত্য যাচাই করা কঠিন হয়ে ওঠে।

হামলার লক্ষ্য কী ছিল

ভারত বলেছে, তারা পেহেলগামে গত মাসে সংঘটিত প্রাণঘাতী হামলার জবাবে ৯টি জায়গায় ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। হামলায় ২৬ জন বেসামরিক লোক নিহত হন। ভারত এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। ইসলামাবাদ এ অভিযোগ অস্বীকার করে প্রমাণ দিতে বলেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে শুধু গোলাবারুদ নয়, চলছে তথ্যের যুদ্ধও—যেখানে সত্য নির্ধারণ করাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ইসলামাবাদ বলেছে, গতকাল বুধবার (মঙ্গলবার দিবাগত রাতে) ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ছয়টি শহর ও একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে।

 

পাকিস্তানের দাবি, এসব হামলায় ৩১ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে তিন বছর বয়সী এক কন্যাশিশুও রয়েছে।

তবে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, ভারতীয় বাহিনী কোনো বেসামরিক নাগরিককে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং বলেন, এ হামলায় ‘বড় ক্ষতি’ হয়নি এবং এটি ছিল ‘সুনির্দিষ্ট’।

নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতীয় সেনারা কি সাদা পতাকা তুলেছেন

পাকিস্তানের সরকারি এক্স অ্যাকাউন্টে বলা হয়, ভারতীয় সেনারা নিয়ন্ত্রণরেখার (এলওসি) একটি সামরিক পোস্টে সাদা পতাকা উড়িয়েছেন, যা সাধারণত আত্মসমর্পণের প্রতীক।

এক্সে পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারারও একই রকম দাবি করে বলেন, ‘প্রথমে তারা তদন্ত (পেহেলগামে হামলার ঘটনায়) থেকে পালিয়েছে, এবার তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও পালিয়েছে।’

ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। যেহেতু দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ চলছে না, তাই নয়াদিল্লি আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে কেন, সেটা পরিষ্কার নয়।

যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে কয়টি, সেগুলো কার ছিল

পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভারতীয় ভূখণ্ডেই ভূপাতিত হয়েছে এবং কোনো পক্ষই অন্যের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি।

ভারত-পাকিস্তানের ৭৭ বছরের পুরোনো সংঘাতে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ উভয় পক্ষের জন্য একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’ হয়ে আছে।

মাধিহা আফজাল, ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক

ভারতীয় নিরাপত্তা সূত্র আল–জাজিরাকে জানায়, তিনটি যুদ্ধবিমান ভারত–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভূপাতিত হয়েছে। তবে সেগুলো কোন দেশের ছিল, স্পষ্ট নয়।

যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে চীনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার দাবিকে ‘মিথ্যা তথ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

পরস্পরবিরোধী দাবির ইতিহাস

আগেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও পাল্টা অভিযোগ উঠে এসেছে, যা পর্যবেক্ষকদের বিভ্রান্ত করেছে। কারও দাবিই পুরোপুরি সত্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে।

পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার জবাবে পাকিস্তান ও পাকিস্তান–শাসিত কাশ্মীরে ভারতের বিমান হামলা, পাল্টাপাল্টি দাবি এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা বিবরণ—দুই দেশের এই সংঘাতে এবারও মূল অস্ত্র ‘তথ্য’।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত বলেছিল, পাকিস্তান–শাসিত কাশ্মীরের বালাকোটে জেইএম (জইশ-ই-মুহাম্মদ) এর ‘সন্ত্রাসী, প্রশিক্ষক, শীর্ষ নেতা ও সশস্ত্র দলের’ বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলা চালানো হয়েছে। এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন।

 

মুজাফফরাবাদে ভারতের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিলাল মসজিদের একাংশ

২০০০ সালে গঠিত জেইএম অনেকবারই ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ সংগঠনটিকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে সংগঠনটির নেতা মাসুদ আজহার পাকিস্তানে অবাধে চলাফেরা করছিলেন। বর্তমানে তাঁর অবস্থানের বিষয়ে জানা নেই।

ভারতের হামলার পর পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করছেন সেনাসদস্যরা

ভারতের হামলার পর পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করছেন সেনাসদস্যরাছবি: এএফপি

 

পাকিস্তান বলেছে, তারা পুলওয়ামা হামলায় জড়িত নয় এবং ভারত ২০১৯ সালে যে বিমান হামলা চালিয়েছিল, তা একটি জনমানবহীন বনে পড়েছিল।

একইভাবে ২০১৬ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের উরিতে একটি সেনাঘাঁটিতে হামলায় ১৮ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত দাবি করেছিল, তারা পাকিস্তান সীমান্তে ‘সন্ত্রাসী ইউনিটগুলোর’ ওপর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছে। পাকিস্তান এ দাবি ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে উড়িয়ে দেয় এবং বলে, ভারত শুধু ‘সীমান্তে গুলিবর্ষণ করেছে…যা সব সময়ই হয়’।

 

ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের গবেষক মাধিহা আফজাল বলেন, ভারত-পাকিস্তানের ৭৭ বছরের পুরোনো সংঘাতে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ উভয় পক্ষের জন্য একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’ হয়ে আছে।

 

এই গবেষক বলেন, ‘এখন আন্তর্জাতিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজে প্রবেশ করা যায়। এতে এটি (তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ) কঠিন হয়ে উঠেছে। তবু যেহেতু উভয় দেশের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সাধারণত সরকারের পছন্দসই বয়ান অনুসরণ করে, তাই সরকার সহজে জনমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নিজের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে পারে।’

শেয়ার করুন