ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত যখন তুঙ্গে, তখন গত বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘মূলত এটি আমাদের দেখার বিষয় নয়।’ তাঁর যুক্তি ছিল, যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষকে সংঘাত থেকে সরে আসার পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু এটি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়।
যদিও এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার সংকট নিরসনে আটঘাট বেঁধে নামেন জেডি ভ্যান্স এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। কারণটা ঠিক সেই পুরোনো ভয়—ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাত যদি পারমাণবিক দিকে গড়ায়? ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একই আশঙ্কায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন।
ভারত–পাকিস্তান দ্বন্দ্বে ভ্যান্স ও রুবিওর সক্রিয় হওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল, দুই দেশের বিমানবাহিনীর মধ্যে শুরু হওয়া গুরুতর আকাশযুদ্ধ এবং ভারতের আকাশসীমায় ৩০০–৪০০ ড্রোন পাঠিয়ে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষার পরীক্ষা। তবে শুক্রবার রাতে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটিতে বিস্ফোরণের পর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ঘাঁটিটি রাজধানী ইসলামাবাদের পাশে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক কেন্দ্র।
নূর খান ঘাঁটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান পরিবহন কেন্দ্র। আকাশে থাকা অবস্থায় জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে যুদ্ধবিমানগুলোকে সেখানেই জ্বালানি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে এ ঘাঁটির। এটি পাকিস্তানের কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগের (এসপিডি) খুব কাছে অবস্থিত। মূলত দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করে এ বিভাগ। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের হাতে প্রায় ১৭০ বা তার বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড (ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমার সামনে থাকা বিস্ফোরক অংশ) রয়েছে। এসব ওয়ারহেড দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা হয়েছে বলেও মনে করা হয়।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের ভয়াবহ হামলার পর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে তীব্র সংঘাত দানা বাধে। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই পর্যটক।
এই সংঘাত দ্রুত সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘাতে পৌঁছতে পারে—মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে এমন কোনো তথ্য ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। অন্তত প্রকাশ্যে পারমাণবিক যুদ্ধসংক্রান্ত স্পষ্ট কোনো বার্তা, যা কেবল পাকিস্তানের তরফ থেকেই এসেছে।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। দুই দেশই অঞ্চলটিকে নিজেদের বলে দাবি করে। কিন্তু অঞ্চলটির দুটি অংশ দুই দেশ নিয়ন্ত্রণ করে।
গতকাল শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে পরিচিত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল, তাদের পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণকাঠামো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। নূর খান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে ভারত সতর্কতা দিতে চেয়েছে যে তারা চাইলে সেটা করতে পারে।
এই সংঘাত দ্রুত সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘাতে পৌঁছাতে পারে—মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে এমন কোনো তথ্য ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। এমনকি প্রকাশ্যে পারমাণবিক যুদ্ধসংক্রান্ত স্পষ্ট কোনো বার্তা কেবল পাকিস্তানের তরফ থেকেই এসেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির সঙ্গে বৈঠক ডেকেছিলেন। ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটি সরকারের এমন একটি ছোট সংস্থা, যেটি পারমাণবিক অস্ত্র কখন এবং কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে বাড়ি। নিজের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এক ব্যক্তি। ৭ মে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি শহরের সালামাবাদ গ্রামেছবি: এএফপি
২০০০ সালে গঠিত এই সংস্থাটির চেয়ারম্যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিজে। এ সংস্থায় আরও আছেন বেসামরিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা এবং সামরিক বাহিনীর প্রধানেরাও সদস্য হিসেবে থাকেন। তবে বাস্তবে এই গোষ্ঠীর প্রধান চালিকা শক্তি হলেন সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির।
তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ দাবি করেছেন, আদৌ ওই সংস্থাটির কোনো বৈঠক হয়নি। গতকাল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার আগে পাকিস্তানের একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বিকল্প হিসেবে পারমাণবিক অস্তিত্বের কথা স্বীকার করলেও বলেন, ‘এটাকে আমাদের অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত—এ নিয়ে আলোচনাও করা উচিত নয়।’
এ বিষয় নিয়ে পেন্টাগনে আলাপ–আলোচনা হয়েছে। গত শুক্রবার সকাল নাগাদ হোয়াইট হাউস স্পষ্টভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে কিছু সাধারণ বিবৃতি এবং ইসলামাবাদ ও দিল্লিতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েকটি ফোনালাপ যথেষ্ট নয়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের হস্তক্ষেপের তেমন কোনো প্রভাবও পড়েনি।
ফক্স নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘আমাদের উদ্বেগ হলো, যখন পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন বড় সংঘাত সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমরা যা করতে পারি তা হলো, দেশগুলোকে কিছুটা শান্ত হতে উৎসাহিত করা।’
ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি—যিনি এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার অনুমতি পাননি। তিনি বলেছেন, জেডি ভ্যান্সের ওই সাক্ষাৎকারের পর প্রশাসনের ভেতরে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয় যে এ সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি হামলা বেড়ে গিয়েছিল। শুরুতে ভারত এমন সব জায়গায় মনোযোগ দিয়েছিল, যা তাদের ভাষ্যমতে, এপ্রিলের হামলার জন্য দায়ী লস্কর-ই-তাইয়েবা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘পরিচিত সন্ত্রাসী ঘাঁটি’। কিন্তু পরে সেখান থেকে সরে এসে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ভারত।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি হামলা বেড়ে গিয়েছিল। শুরুতে ভারত এমন সব জায়গায় মনোযোগ দিয়েছিল, যা তাদের ভাষ্যমতে, এপ্রিলের হামলার জন্য দায়ী লস্কর-ই-তাইয়েবা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘পরিচিত সন্ত্রাসী ঘাঁটি’। কিন্তু পরে সেখান থেকে সরে এসে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ভারত।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি বড় উদ্বেগ ছিল, সংঘাত নিরসনের বার্তাগুলো দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না।
আর তাই মার্কিন কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন যে ভ্যান্স যেন সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেন। ভ্যান্সের বার্তা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন অনুযায়ী সহিংসতা যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহভাবে বেড়ে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে—এ আশঙ্কা প্রবল।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্য অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদি যাতে হামলার বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু ভাবেন, সে জন্য তাঁকে চাপ দেন ভ্যান্স। যেমন এমন কোনো সমঝোতার পথে হাঁটা, যা পাকিস্তানের পক্ষেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মোদি ভ্যান্সের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও তাঁর কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দেননি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিও পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল মুনিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ফোন দিয়ে সংঘাত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করছেন।
‘আমাদের উদ্বেগ হলো, যখন পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন বড় সংঘাত সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমরা যা করতে পারি, তা হলো দেশগুলোকে কিছুটা শান্ত হতে উৎসাহিত করা।’
জেডি ভ্যান্স, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট
অন্তত প্রথম দিকে তাঁর এসব পদক্ষেপ ঠিক কতটা কার্যকর ছিল, তা স্পষ্ট নয়।
গতকাল ওই ফোনালাপগুলোর বিস্তারিত জানাতে কোনো সংবাদ সম্মেলন করেনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। বরং মূল বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছেন। সেখানে রুবিও ও দক্ষিণ এশীয় নেতাদের মধ্যকার কথোপকথনের প্রকৃত রসায়ন বা মেজাজ বোঝার সুযোগ ছিল না। তবে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত একটানা চলতে থাকা ফোনালাপগুলো যুদ্ধবিরতির জন্য একটা ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আলোচনার বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্যের অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাকিস্তানের একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত ৪৮ ঘণ্টায় মার্কিন হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে রুবিওর ভূমিকা এই সমঝোতা নিশ্চিত করতে মূল ভূমিকা রেখেছে। তবে শনিবার রাতেও সীমান্তে গুলি বিনিময়ের খবর পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে ইসলামাবাদে আয়োজিত সামরিক কুচকাওয়াজে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শাহিন-৩ প্রদর্শন করা হয়। ২৫ মার্চ, ২০২১ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভূমিকা বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্ব ও সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। (যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার) এই ফলাফল নিশ্চিত করতে সহায়তার জন্য পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে আমরা এটি গ্রহণ করেছি।’
তবে এর বিপরীতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি।
এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে বা ইতিমধ্যে যেসব ক্ষতি হয়েছে, তা নতুন করে প্রতিশোধের জন্ম দেবে না—সে বিষয়েও এখনো পরিষ্কার কিছু জানা যাচ্ছে না। কিছু সূত্রে দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তান অন্তত পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। (ভারতের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য আসেনি।)
পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।