ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সম্প্রতি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার পর মুসলিমদের ব্যাপকভাবে ধরপাকড় ও তাঁদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে। মানবাধিকারকর্মীদের আশঙ্কা, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পেহেলগামের হামলাকে ব্যবহার করে দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর দমন–পীড়ন আরও বৃদ্ধি করছে।
কাশ্মীরের পেহেলগাম শহরের কাছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে একজন বাদে বাকি প্রায় সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। পর্যটক হিসেবে তাঁরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে পেহেলগামে গিয়েছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ জোরালোভাবে নাকচ করে দিয়েছে।
পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার জবাবে ভারত সামরিকভাবে পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে তাদের ঘাঁটি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। পাকিস্তান সরকারের একজন মন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন ভারত শিগগিরই সামরিক হামলা চালাতে পারে।
এই মুহূর্তে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মূলত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন আন্তসীমান্ত নদীগুলোর পানিপ্রবাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে। একই সঙ্গে বিজেপি সরকার ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিমদের হয়রানি করছে। তারা এটিকে ‘অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান’ বলে দাবি করছে।
মোদির বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে কর্তৃপক্ষ এই সুযোগে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ এবং ‘রোহিঙ্গাদের’ বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন। ‘পাকিস্তানি’ বা ‘বাংলাদেশি’ তকমা অনেক সময়েই হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের অভ্যন্তরীণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে।
উত্তর প্রদেশ ও কর্ণাটক—এই দুই রাজ্যে মুসলিমদের হত্যার খবর পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের খবরে সেগুলোকে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরে ইতিমধ্যেই শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে যাঁদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তাঁদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক সরকারি কর্মকর্তার মতে, প্রায় দুই হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে, যা অনেকটা সমষ্টিগত শাস্তির মতো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিছবি: এএফপি
ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও কাশ্মীর রাজ্যের মানুষ হুমকি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কিছু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী রাস্তায় কাশ্মীরি হকারদের মারধর করছে। রাজ্য ছেড়ে না গেলে কাশ্মীরিদের মারধর করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছে তারা। এসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলছেন, ‘পেহেলগামের হামলা ভয়ংকর ছিল। তবে সেই হামলাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে যেন সংখ্যালঘুদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। অবৈধ গ্রেপ্তার বা তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
মীনাক্ষী আরও বলেন, ‘চরম জাতীয়তাবাদী টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ঘৃণামূলক বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলে সহিংসতা বাড়ছে।’
সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার পর প্রথমে কাশ্মীরের মানুষকে লক্ষ্য করে প্রতিক্রিয়া শুরু হলেও তা ধীরে ধীরে পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণায় রূপ নেয়। বিশ্লেষকদের মতে, মুসলিমদের খারাপভাবে উপস্থাপনে বিজেপি তাদের দীর্ঘদিনের এই রাজনৈতিক কৌশল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যবহার করে আসছে।
পেহেলগামে হামলার পরপরই ভারতের বিভিন্ন শহরে অধ্যয়নরত কাশ্মীরের শিক্ষার্থীরা হুমকি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সরকারের পক্ষ থেকে কাশ্মীরিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের বিভিন্ন শহরে পাঠিয়েছেন।
উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ২৩ এপ্রিল এক মুসলিম রেস্তোরাঁকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আরেকজন আহত হন। হামলাকারীরা নিজেদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্য দাবি করে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে তারা বলেছে, ‘মা ভারতের নামে ২৬ জনের বদলে ২ হাজার ৬০০ জনকে মারব।’ অবশ্য উত্তর প্রদেশ পুলিশ দাবি করছে, খাবার নিয়ে বিরোধের জেরে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কর্ণাটক রাজ্যে পাকিস্তানপন্থী স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ তুলে আরেক মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ধরপাকড় চলছে গুজরাট রাজ্যে। গত সোমবার রাজ্যের পুলিশপ্রধান জানান, তাঁর কর্মকর্তারা ‘বাংলাদেশি সন্দেহে’ ৬ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে, পুরুষদের দড়ি দিয়ে বেঁধে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলাওয়ামার মুররান গ্রামে সন্দেহভাজন এক সন্ত্রাসীর বাড়ি ভেঙে ফেলার পর ধ্বংসস্তূপের ওপর লোকজন হাঁটছেছবি: রয়টার্স
পুলিশের এই ধরপাকড় যে কতটা নির্বিচারে চলছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় পুলিশপ্রধানের বক্তব্যে। তিনি স্বীকার করেন, এ পর্যন্ত আটক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ৪৫০ জনকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে।
গুজরাট সরকার হ্রদের কাছে মুসলিমদের বসবাসরত একটি বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে নেওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সেখানে অভিযান চালাতে বেশ কয়েকটি বুলডোজার ও ময়লার ট্রাক সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ওই বস্তিতে অভিযানে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে।
গুজরাট রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্ষ সাঙ্গাভি বলেছেন, ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ বিরুদ্ধে অভিযানের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে বস্তির দুই হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সমাজকর্মী হর্ষ মন্দার বলেন, ভারতের মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’ বলাটা একটি পুরোনো রাজনৈতিক কৌশল, যা মোদি সরকার ও তাঁদের দল বারবার ব্যবহার করছে।
বস্তির বাসিন্দারা উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখতে আদালতে একটি পিটিশন করলেও আদালত তা নাকচ করে দেন। উচ্ছেদের পক্ষে সরকার আদালতে জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি তুলে ধরেছে।
পিটিশনকারীরা যুক্তি দেখান, তাঁরা ভারতের নাগরিক ও তাঁদের কাছে প্রমাণপত্র আছে। তাঁরা আরও বলেন, জায়গাটি সরকারি হলেও উচ্ছেদের আগে কোনো নোটিশ বা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
গুজরাটের শহর আহমেদাবাদের বাসিন্দারা বলেন, যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই ভারতীয় নাগরিক। তাঁরা ‘পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, অপমান ও সহিংসতার’ শিকার হয়েছেন। পুলিশও শিগগিরই বুঝতে পেরেছে, আটক ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশই ভারতের নাগরিক।
হর্ষ মন্দার বলেন, এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বেআইনি ও অসাংবিধানিক কাজ করছে বিজেপি সরকার।