বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস কিনে বিক্রি করেন তিন হাজারের বেশি পরিবেশক। সাড়ে ১২ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে পরিবেশকদের কোম্পানি পর্যায়ে বর্তমানে খরচ হয় ৭৮৪ টাকা। আরও কিছু খরচ যুক্ত হয়ে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করার কথা ৮২৫ টাকায়; কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। বিপিসির একটি তদন্ত প্রতিবেদনেও দামের তারতম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, গ্রাহকদের কাছে কম দামে সরবরাহের জন্য মূলত এলপি গ্যাস বিক্রি করা হয়; কিন্তু এই গ্যাস বিক্রি করে পরিবেশকেরা পকেট ভারী করেন। ভোক্তাদের লাভ হয় না।
বিপিসির এই চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)। বিপিসি ও চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বাজারের খুচরা গ্যাস বিক্রেতা, পরিবেশক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে বাড়তি দরে বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দেশে সরকারি-বেসরকারি—দুভাবে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয়। সর্বশেষ ৪ মে প্রকাশিত মূল্য সমন্বয়ক আদেশ অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে বেসরকারি খাতে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ১২ কেজি সিলিন্ডারে দাম ১ হাজার ৪৩১ টাকা। অন্যদিকে সরকারি কোম্পানির মূল স্থাপনা বা ডিপো থেকে পরিবেশকদের সিলিন্ডার কিনতে খরচ হচ্ছে ৭৮৪ টাকায় (১২.৫ কেজি)। এর সঙ্গে পরিবেশকদের স্থানীয় পরিবহন খরচ ২১ টাকা, পরিচালন খরচ যুক্ত হয় আরও ২০ টাকা। অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার হচ্ছে ৮২৫ টাকা। ৪ মের আগে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার ছিল ৬৯০ টাকা। কিন্তু এই দামে ভোক্তারা গ্যাস পেতেন না।
চট্টগ্রাম নগরের বাটালি রোডের তাহমিনা অ্যান্ড সন্স পদ্মা ও এসএওসিএল থেকে গ্যাস নিয়ে ব্যবসা করে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর প্রতিষ্ঠানে পদ্মার সাড়ে ১২ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছিল ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়ে শাহ আলম বলেন, দুই কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ গ্যাস তিনি পান, তা দিয়ে দোকান ভাড়াও ওঠে না। এর বাইরে পরিবহনসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। এ কারণেই বাড়তি রাখতে হয়।
একই দিন নগরের মুরাদপুর, ষোলশহর, বায়েজিদ, কদমতলী এলাকা ঘুরে কোথাও সরকারি চার কোম্পানির গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়নি। নগরের পাহাড়তলীর আরেক পরিবেশক মোহাম্মদ ফজলুর কাছে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। তিনি যমুনা ও এসএওসিএল থেকে গ্যাস নিয়ে ব্যবসা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম কাদের এন্টারপ্রাইজ। বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়ে ফজলু বলেন, কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। এ কারণে নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব হয় না।
বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি খোরশেদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলী। খোরশেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিপিসির চার কোম্পানি থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যায় না। ফলে কম গ্যাস বিক্রি করে দোকানভাড়া, ট্রেড লাইসেন্স ফি, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্সের নবায়ন ফি তোলা সম্ভব হয় না। এ কারণে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়।
সরকার–নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার–নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেওয়ার বিষয়টি তাঁরা জেনেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা পদক্ষেপ নেবেন। পাশাপাশি সরকারি গ্যাস বেসরকারি সিলিন্ডারে ঢুকিয়ে বিক্রি করার বিষয়েও তাঁরা অভিযোগ পেয়েছেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বিষয়টি বন্ধ করার নির্দেশনা দেবেন।
বাড়তি দামে এলপি গ্যাস বিক্রি নিয়ে বিপিসির একটি তদন্ত প্রতিবেদনে আলোচনা হয়েছে। ৪ মে ওই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, বিপিসির এলপি গ্যাস পরিবেশক নিয়োগ ও বিপণন নীতিমালাটি পুরোনো। ফলে বাস্তবতার নিরিখে তা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। বিইআরসি বা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নির্ধারিত সরকারি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য ৬৯০ টাকা (বর্তমান মূল্য ৮২৫)। অন্যদিকে বেসরকারি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য ১ হাজার ৪৫০ টাকা (বর্তমান মূল্য ১ হাজার ৪৩১ টাকা)। সরকারি ও বেসরকারি গ্যাস সিলিন্ডারের এই মূল্যের পার্থক্য কমানো না গেলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাবে।
ভোক্তার ব্যয় কমাতে সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে সিলিন্ডার বিক্রি করা যেতে পারে বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপিসির অধীন কোম্পানিগুলোর ডিপো বা বিক্রয় অফিসের তত্ত্বাবধানে গ্রাহক কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের কাছে সরকার–নির্ধারিত মূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করা যেতে পারে।\
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, চার কোম্পানিতে এলপি গ্যাস পরিবেশকের সংখ্যা ৩ হাজার ১০১। গত পাঁচ বছরে মোট এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৫২ হাজার ২৩০ টন বা ৫ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার কেজি।
সরকারি এলপি গ্যাস বিক্রি করে পরিবেশকেরা লাভবান হন, ভোক্তাদের সুফল মেলে না বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার–নির্ধারিত মূল্যে গ্রাহকেরা গ্যাস পাচ্ছেন কি না, তা তদারকির দায়িত্ব বিইআরসি ও বিপিসির; কিন্তু এই দায়িত্ব তারা ঠিকভাবে পালন করে না। এ সুযোগ নিয়ে পরিবেশকেরা বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন। ফলে সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি বাড়াতে হবে।