মঙ্গল গ্রহে একদিন মানুষের বসতি হবে—এ স্বপ্ন নিয়ে সারা পৃথিবীতেই চলছে নানান গবেষণা। মঙ্গল গবেষণায় তরুণদের সম্পৃক্ত করতে আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। তেমনই একটি আয়োজন ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি), যার আয়োজক মার্স সোসাইটি নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থা। এই প্রতিযোগিতায় মূলত মঙ্গল গ্রহে গবেষণা-উপযোগী রোবট (মার্স রোভার) তৈরি করতে হয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কয়েক বছর ধরেই ইউআরসিতে অংশ নিয়ে আসছেন। আমাদের ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) মার্স রোভার দলের যাত্রা শুরু ২০২১ সালে। তখন হাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না, বিশাল ল্যাব ছিল না, বড় বাজেট ছিল না; কিন্তু একদল সাহসী তরুণের স্বপ্ন ছিল। ছিল শেখার আগ্রহ আর নিজেকে প্রমাণ করার জেদ। আমার সৌভাগ্য, সেই দলে আমিও ছিলাম। সে সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের সাবেক মেন্টর আকিব জামান। তাঁর উৎসাহে আমরা ছোট একটি প্রোটোটাইপ দিয়ে শুরু করি। থ্রি–ডি ডিজাইন থেকে শুরু করে সিমুলেশন সফটওয়্যার—সবই আমাদের ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়েছে। রাতজাগা পরিশ্রমের ফল হিসেবে তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রথম রোভার। নাম ‘মেভেন’।
২০২২ সালে আমরা মেভেনকে নিয়ে ইউআরসির ফাইনাল রাউন্ডে অংশ নিই। সেবার প্রতিযোগিতায় আমরা ১৩তম হয়েছিলাম। এর পর থেকে প্রতিবছরই রোভার তৈরির চ্যালেঞ্জ অংশ নিয়ে এসেছে ইউআইইউ। এ বছর আমাদের রোভারের নাম ছিল ‘অ্যাক্সিয়োস’। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশনে আয়োজিত ফাইনালে বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ হয়েছি আমরা। তার চেয়েও আনন্দের খবর হলো, আমাদের দল পেয়েছে ‘বেস্ট সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’। এখানে মনে রাখা দরকার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভূতত্ত্ব বিভাগ নেই; এমনকি দলে কোনো ভূতত্ত্ববিদও ছিলেন না। আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজেরা শিখে, গবেষণা করে এই স্বীকৃতি পেয়েছেন।
জানিয়ে রাখি, মূল পর্বে বাংলাদেশ থেকে আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছিল। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি হয়েছে অষ্টম, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ১৪তম ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ১৮তম।
এ বছর আমাদের রোভারের নাম ছিল ‘অ্যাক্সিয়োস’ছবি: সংগৃহীত
শুরু থেকেই ইউআইইউয়ের মার্স রোভার দলের সঙ্গে ছিলাম। তবে এই পুরো যাত্রায় আমার ভূমিকাও বদলে গেছে অনেকখানি। ২০২২ সালে দলের একজন সাধারণ সদস্য ছিলাম। ইউআইইউতে শিক্ষকতার সুবাদে এখন আমি দলের সুপারভাইজার। আগে কাজ করতাম নিজে শেখার জন্য। এখন নিজে তো প্রতিনিয়ত শিখিই, শিক্ষার্থীদেরও শেখাতে চেষ্টা করি। ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়ে ওঠার এই রূপান্তর আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা।
গত কয়েক বছরে কত যে গল্প জমা হয়েছে, একবার ফাইনালে রোভার নিয়ে আমরা মাঠে কাজ করছি। হঠাৎ দেখি, রোভারটির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাউন্ট চাপে বেঁকে যেতে শুরু করেছে। সেটা ঠিক করতে গেলে পুরো কাঠামো খুলতে হতো, অথচ আমাদের হাতে সময় তখন খুব কম। আমরা তড়িঘড়ি দুটি চাকার মাঝখানে একটি বাঞ্জি রশি লাগিয়ে দিই। এই অস্থায়ী ‘বাঞ্জি সাসপেনশন’ এত ভালো কাজ করছিল যে একজন বিচারক এসে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। অবাক তো বটেই, মুগ্ধও হয়েছিলেন তিনি।
আমাদের দল পেয়েছে ‘বেস্ট সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ছবি: সংগৃহীত
এমন ছোট ছোট গল্প, অভিজ্ঞতাই আসলে আমাদের চ্যালেঞ্জ পার হতে শেখায়, সমস্যা সমাধানের অনুপ্রেরণা দেয়। এসব প্রতিযোগিতায় শুধু যে কারিগরি জ্ঞান অর্জন হয়, তা নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর শেখার মানসিকতাও গড়ে ওঠে। অন্যান্য দলের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কাজ দেখেও আমরা নানান কিছু শিখি। আয়োজকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা নাসা, স্পেসএক্স বা ব্লু অরিজিনের মতো বিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে আলাপ থেকে অনেক নতুন দিক সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে।
আমি মনে করি, এ ধরনের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত কী ফল পেলাম, সেটাও আসলে মুখ্য নয়; বরং ঠেকে ঠেকে শেখা, ভুলগুলো শোধরানো, আত্মবিশ্বাস পাওয়া, নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়া—এসবই বড় অর্জন।