মেডিকেল অফিসার থেকে যেভাবে আইসিডিডিআরবির প্রথম বাংলাদেশি নির্বাহী পরিচালক হলেন তাহমিদ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 31-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

কয়েক দিন হলো নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় ফিরেছেন তাহমিদ আহমেদ। টাইম সাময়িকীর আমন্ত্রণে ‘টাইম ১০০ ইমপ্যাক্ট ডিনার: লিডারস শেপিং দ্য ফিউচার অব হেলথ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। সাময়িকীটির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী, সেখানে তিনি একটি অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যও দিয়েছেন।

২৪ মে আইসিডিডিআরবিতে টাইম–এর স্বীকৃতি নিয়েই আলাপ শুরু হলো। পরে সেই আলাপ গড়াল জীবনের নানা দিকে।

বেতন আড়াই হাজার টাকা

১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেন তাহমিদ আহমেদ। তারপর সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে কয়েক মাস কাজ করেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিনি বললেন, ‘১৯৮৫ সালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে আইসিডিডিআরবিতে যোগ দিই। বড় ভাইয়ের কথায় আইসিডিডিআরবির কাজটিকে ঢাকায় থাকার একটা উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। প্রথম মাসের বেতন ছিল সম্ভবত আড়াই হাজার টাকা।’

আইসিডিডিআরবিতে তখন বিদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বড় বড় সব পদে বিদেশি। সেই সময় নির্বাহী পরিচালক ছিলেন বিখ্যাত শিশুবিশেষজ্ঞ রজার ইকেলস। তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘কোনো দিন ভাবিনি একদিন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক হব। ও রকম কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যও আমার ছিল না।’

আপনার কি কখনো পুষ্টিবিদ বা পুষ্টিবিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘না।’

আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে কাজ করার সময় অপুষ্টির বিষয়টি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আসে। তাহমিদ আহমেদের ভাষায়, ‘প্রতিদিন তীব্র অপুষ্টির শিশুদের দেখতাম। অনেক শিশু মারা যেত। এটা ছিল মেডিকেল ইমার্জেন্সি, কিন্তু সব শিশুকে বাঁচানো যেত না। অপুষ্টির কারণে তখন রাতকানা রোগ ছিল তীব্র পর্যায়ে। পুষ্টি নিয়ে কাজ করার পেছনে এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভূমিকা ছিল।’

আইসিডিডিআরবিতে কাজ শুরুর পর ইউরোপ বা আমেরিকার অনেক পুষ্টিবিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পুষ্টিবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে তিনি এ দেশের কয়েকজনের কাজে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা ইকবাল কবির এবং আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী এস কে রায় অন্যতম।

 

 

টাইম সাময়িকীর ‘বিশ্ব স্বাস্থ্যে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তি’র তালিকায় জায়গা পেয়েছেন ড. তাহমিদ আহমেদ

টাইম সাময়িকীর ‘বিশ্ব স্বাস্থ্যে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তি’র তালিকায় জায়গা পেয়েছেন ড. তাহমিদ আহমেদ

দিন দিন আইসিডিডিআরবির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তাহমিদ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক হন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির শুরুর সময়ে আইসিডিডিআরবির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পান। পরের বছরের শুরুতেই নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পান। আইসিডিডিআরবির ৬০ বছরের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ।

সব সামলে গবেষণা

স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা খাতের যে বিষয়গুলো অবহেলিত, নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ কম পায়, রাজনীতিবিদেরা কথা কম বলেন, গণমাধ্যমে স্থান পায় না, অপুষ্টি তেমনই একটি বিষয়। সেই অপুষ্টিকেই গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাহমিদ আহমেদ। একটি না, ১০০টা না, এখন পর্যন্ত ৫১৪ গবেষণা প্রবন্ধের প্রধান লেখক অথবা সহ-লেখক তিনি। প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা বা বিজ্ঞান সাময়িকীতে। বর্তমানে অপুষ্টিবিষয়ক প্রায় এক ডজন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে তিনি জড়িত।

আইসিডিডিআরবির জনবল এখন পাঁচ হাজারেরও বেশি। এমন একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে গবেষণা, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখা, সম্পাদনার মতো কাজের চাপ সামলানো চাট্টিখানি কথা না। দিনরাত একাকার করে সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন তাহমিদ আহমেদ।

১৩ মে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত টাইম–এর নৈশভোজের আয়োজনে তাঁর বক্তৃতায় ৪০ বছর আইসিডিডিআরবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে অপুষ্টি নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতাও শুনিয়েছেন তাহমিদ আহমেদ। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সেন্ট লুইসের জেফরি গর্ডনের সঙ্গে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে করে চলা একটি গবেষণার সম্পর্কে তিনি সেখানে বলেন, ‘আপনাদের অনেকেই হয়তো ভাবেন যে অপুষ্টি কেবল খাবারের অভাবের কারণেই হয়। হ্যাঁ, খাবারের অভাব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, তবে এটিই একমাত্র কারণ না। গত কয়েক দশকে আমাদের গবেষণা দেখিয়েছে যে অপরিচ্ছন্নতার কারণে ব্যাকটেরিয়া-জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, তারা শিশুর ছোট অন্ত্রে উপনিবেশ স্থাপন করে, অন্ত্রের ক্ষতি করে। এই ক্ষতির কারণে, শিশু যে খাবার খায়, তা থেকে সে ঠিকঠাক পুষ্টি পায়, সে অপুষ্টিতে ভোগে।’

 

ড. তাহমিদ আহমেদ

ড. তাহমিদ আহমেদছবি: সুমন ইউসুফ

খাদ্য বেছে নেওয়ার সঙ্গেও পুষ্টি ঠিক থাকা না-থাকারও সম্পর্ক আছে। একই খাদ্য খেয়ে কিছু শিশু হৃষ্টপুষ্ট হয়, কিছু শিশুর অপুষ্টি দেখা দেয়। তাহমিদ আহমেদ ও তাঁর দেশি-বিদেশি সহ–গবেষকেরা দেখেছেন, খাদ্য থেকে অণুপুষ্টিকণা গ্রহণ করতে সব শিশুর অন্ত্র প্রস্তুত থাকে না। অন্ত্রে কোটি কোটি অণুজীব থাকে। অন্ত্রে উপকারী অণুজীবের প্রাধান্য তৈরি করে তেলাপিয়া, ছোলা, কাঁচা কলা ও চিনাবাদামের মতো খাবার। এ ধরনের উপকরণ দিয়ে স্থানীয় কোম্পানির মাধ্যমে খাবার তৈরি করেছেন গবেষকেরা। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু ও মাকে সেই খাবার খাওয়ানো হচ্ছে পাঁচটি দেশে। দেশগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তানজানিয়া ও মালি। এই গবেষণা ফলাফল জানার জন্য প্রায় সারা বিশ্বের পুষ্টিবিদেরা উন্মুখ হয়ে আছেন।

মাস তিনেক আগে প্রথম আলোতে অনুষ্ঠিত পুষ্টিবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তাহমিদ আহমেদ। অনুষ্ঠানে শুরুর আগে এই প্রতিবেদক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাহমিদ ভাই, অন্ত্র ঠিক রাখার জন্য কী খাব?’

উত্তরে এই পুষ্টিবিদ বলেছিলেন, ‘কাঁচা কলা আর ছোলা।’

আপনাদের অনেকেই হয়তো ভাবেন যে অপুষ্টি কেবল খাবারের অভাবের কারণেই হয়। হ্যাঁ, খাবারের অভাব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, তবে এটিই একমাত্র কারণ না।

ড. তাহমিদ আহমেদ

পুরান ঢাকায় শৈশব

তাহমিদ আহমেদদের আদি বাড়ি ময়মনসিংহ। তবে বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। বাবার চাকরির সুবাদে কিছুটা সময় কেটেছে পাকিস্তানে।

১৯৭৪ সালে লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তাহমিদ আহমেদ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রাদার রবার্টের একটা উপদেশ তিনি পাথেয় হিসেবে নিয়েছিলেন। যা আজও তাঁর মনে জ্বলজ্বল করে, ‘ব্রাদার বরার্ট বলতেন, পৃথিবী জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এমন কিছু করবে যেন বেকার না থাকতে হয়।’

এসএসসি শেষ করে তাহমিদ ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। ১৯৭৬ সালে নটর ডেমের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাহমিদ আহমেদ। ‘হোস্টেলের ছাদে রাত একটা-দুটা পর্যন্ত মার্ক্স-এঙ্গেলস নিয়ে আলোচনায়, বিতর্কে অংশ নিয়েছি। সমকালীন রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করেছি,’ বলেন তিনি।

মেডিকেলে পড়ার সময় সন্ধানীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। রক্তদান, চক্ষুদান কর্মসূচিতে অংশ নিতে নিয়মিত ভৈরব, জামালপুর যেতেন। বললেন, ‘ট্রেনের টিকিট কাটা না-কাটা নিয়ে মজার মজার গল্প আছে। ট্রেনের টিটি সাহেবরা আমাদের চিনাবাদাম খাওয়াতেন, আজও মনে আছে।’

 

টাইম সাময়িকীর চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদ

টাইম সাময়িকীর চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদ

ঘরে-বাইরে

তাহমিদ আহমেদ যখন মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে সায়েরা বানুদের তখন প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়লেও তাই দুজনের সাক্ষাৎ হয়নি। আইসিডিডিআরবিতে দুজনের সাক্ষাৎ হলো। দুজনই তখন সংস্থাটির জুনিয়র পদে কাজ করেন।

চেনা–জানার পর ১৯৯২ সালে বিয়ে। সায়েরা বানু বর্তমানে আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও সংস্থাটির ইমার্জিং ইনফেকশনস বিভাগের প্রধান।

অফিস সামলে নিজের গবেষণার কাজ করেও নিজস্ব জগতে ঠিকই বিচরণ করেন তাহমিদ। যেমন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মিস করেন না। জানালেন, ‘গত সপ্তাহেও স্কুল আর কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি।’

আর কিছু? বললেন, ‘নিশ্চয়ই আছে। রাতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে টেলিভিশনে টক শো দেখি। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে বোঝার চেষ্টা করি। আমরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলি।’

আর উপভোগ করেন পড়াতে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথে তিনি পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনের অধ্যাপক। তাঁর ভাষায়, ‘এখানে অনেক দেশের শিক্ষার্থী পড়তে আসে। এদের পড়িয়ে, এদের সঙ্গে কথা বলে, সময় কাটিয়ে আনন্দ পাই। উপভোগ করি।’

শেয়ার করুন