সার–বীজের নিয়ন্ত্রণ কিছু কোম্পানির হাতে যাওয়ায় কৃষকের পরিস্থিতি নাজুক
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 05-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

গ্রামাঞ্চলে কৃষি ঘিরে ব্যবসা–বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু দেশের কিছু কোম্পানির হাতে বীজ ও সারের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় কৃষকের জন্য নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতি, কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনা ও কৃষককে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কৃষক ও সারা দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কথাগুলো বলেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

আজ রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দৈনিক বণিক বার্তা আয়োজিত কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ–প্রকৃতি সম্মেলন–২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বীজ ও সারের ক্ষেত্রে কয়েকটি কোম্পানি বনাম কৃষক এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা পোল্ট্রি বলি, বীজের ক্ষেত্রে বলি, কিছু কোম্পানি এগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে।

এই অলিগোপলি (কয়েকটি কোম্পানির হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ) থেকে কৃষককে কে রক্ষা করবে—এমন প্রশ্ন তুলে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘কৃষকদের একদিকে কৃষি উপকরণ ব্যবহার করতে হয়, সংগ্রহ করতে হয়। আবার সে যখন বিক্রি করতে যায় তখন দেখা যায় সংগ্রহশালা নেই, হিমাগার নেই। সরকারি ক্রয়ের যে ব্যবস্থা সেটাতে কৃষকের কোনো লাভ হয় না। এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোম্পানি তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলেছবি: সাজিদ হোসেন

কৃষকের স্বার্থে, দেশের প্রয়োজনে কোনো গবেষণা ও পরিকল্পনা না হওয়াকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষক, বাংলাদেশের প্রাণ–প্রকৃতি, বাংলাদেশের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা চিন্তা করে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি। একেক দেশের শক্তি ও সীমাবদ্ধতার জায়গা একেক রকম। সেগুলোকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা ও গবেষণা হওয়া দরকার ছিল।

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মাটি বাংলাদেশের শক্তির জায়গা। উর্বরতা এত বেশি যে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় মানুষের কোনো উদ্যোগ ছাড়াই অনেক কিছু ফলে। আরেকটা শক্তির জায়গা পানি। মাটির নিচে পানি, ভূগর্ভস্থে পানি। নদীনালা, খালবিলে পানি। এ রকম ঐশ্বর্য, এ রকম একটা শক্ত ভিত্তি, এটা পৃথিবীর কয়টা দেশে আছে?’

 

 

কৃষিজমি সুরক্ষা আইন হচ্ছে দুই–তিন মাসের মধ্যে

দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার দুই–তিন মাসের মধ্যে কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ও ল্যান্ড জোনিং আইন করতে যাচ্ছে।

পানিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, ‘জন্মের পর থেকে আমরা শুনে আসছি, বাংলাদেশে এ রকম একটা আইন হবে। এ বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়ে গেছে। আরেকটা আন্তমন্ত্রণালয় সভা হবে। এরপর পাবলিক কনসালটেশনের পর আশা করি, দুই–তিন মাসের মধ্যে আমরা এটি পাস করে ফেলব।’

পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যক্তি হিসেবে যার যার কনজাম্পশন প্যাটার্ন (ভোগের ধরন) পাল্টানো দরকার। পরিবেশের বিষয় আসলে ইফ, বাট, হাওয়েভারে চলে যায়। পরিবেশকে ইফ, বাট, হাওয়েভার থেকে মুক্ত করতে হবে।’

কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলেছবি: সাজিদ হোসেন

 

উদাহরণ দিয়ে পানিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, ‘একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নদীদূষণ করছে। আরেক দিকে এক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও করেছে। বারবার নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ আছে। যখন আমরা সেটা বন্ধ করতে যাব, তখন একটা প্রচণ্ড বিতর্ক সামনে নিয়ে আসা হবে, সেটা গণমাধ্যমও করে যে এক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে।’

এভাবে বাট ও ইফের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান দূষণ করছে। ধরে নিই এখানে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তাহলে বুড়িগঙ্গা, বংশী ও ধলেশ্বরীর ওপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা কত?

আলোচনায় মাল্টিমোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কৃষি ও প্রাণ–প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। কৃষির সফলতা নির্ভর করে প্রাণ–প্রকৃতির ওপর।

জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘একসময় কৃষিজমি বাড়ানোর জন্য বনজঙ্গল কাটা হয়েছে। এখন আমরা সেটা করতে পারব না। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দুটি উপায়। একটা জমি বাড়ানো। আরেকটা একই জমিতে উৎপাদন বাড়ানো।’

আগামী বিপ্লব হবে প্রাণ–প্রযুক্তির বিপ্লব উল্লেখ করে পানিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের জমি কম। সেটা আরও কমছে, কারণ নগরায়ণ দ্রুত বাড়ছে। শিল্পায়নও বাড়ছে। আছে নদীভাঙনও।’

কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন মাল্টিমোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫–এর দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন মাল্টিমোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। আজ সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলেছবি: সাজিদ হোসেন

এই পরিস্থিতিতে নতুন নতুন যেসব দ্বীপ তৈরি হচ্ছে সেগুলোকে কীভাবে কৃষির আওতায় আনা যায়, সেটা নিয়ে ভাবার পরামর্শ দেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা যেমন জরুরি তেমনি স্বাস্থ্যনিরাপত্তাও জরুরি। সে জন্য সরকারের উচিত এ বিষয়ে নীতি গ্রহণ করা।

ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেকের জমি আছে, কিন্তু তারা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে আপনি যদি কৃষি খাতের জমি রাখেন, তাহলে সরকার আপনার জমি নিয়ে নিতে পারে। কৃষি উন্নয়নের জন্য অর্গানাইজড ফার্মকে দিয়ে দিতে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের একটা আইন প্রয়োজন।’

দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় প্রাণ–প্রকৃতি সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহসভাপতি খুশী কবির, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন ও আইইউবিএটির উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুর রব।


 

শেয়ার করুন