‘পরিবেশটা কেমন জানি লাগছিল। একটু অদ্ভুত!’
গত সোমবার আটলান্টার মার্সিডিজ–বেঞ্জ স্টেডিয়ামে লস অ্যাঞ্জেলেস এফসির (এলএএফসি) বিপক্ষে ম্যাচটা শেষে বলেছিলেন চেলসির কোচ এনজো মারেসকা।
কেন অদ্ভুত লাগছিল? মার্সিডিজ-বেঞ্জ স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ৭০ হাজারের বেশি। চেলসি-এলএএফসির ম্যাচ দেখতে সেদিন গ্যালারিতে ছিলেন মাত্র ২২ হাজার দর্শক! মানে তিন ভাগের এক ভাগ মাঠও ভরেনি। ইউরোপজুড়ে ভরা গ্যালারির উন্মাদনায় খেলে অভ্যস্ত চেলসি এ রকম ফাঁকা মাঠে খেলছে, কোচের কাছে তো অদ্ভুত লাগবেই। অথচ ম্যাচটা ছিল ক্লাব বিশ্বকাপের!
প্রাক্-মৌসুম প্রীতি ম্যাচ খেলতে সর্বশেষ চেলসি যেবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল, গড়ে প্রতি ম্যাচে দর্শক হয়েছিল ৫০ হাজারের মতো। অথচ সেই চেলসির ক্লাব বিশ্বকাপের ম্যাচে দর্শক মাত্র ২২ হাজার। ভাবা যায়!
শুধু ওই ম্যাচ নয়, এখন পর্যন্ত ক্লাব বিশ্বকাপের বেশির ভাগ ম্যাচেই গ্যালারি খাঁ খাঁ করছে! আটলান্টা, সিয়াটল, নিউ জার্সি, অরল্যান্ডো—সব মাঠে একই দৃশ্য। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১২টি ম্যাচের মধ্যে কোনোটিতেই স্টেডিয়াম পূর্ণ হয়নি, এমনকি অর্ধেকও ভরেনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে!
ক্লাব বিশ্বকাপে স্টেডিয়ামের গ্যালারি এমন ফাঁকাই থাকছেছবি: এএফপি
অথচ ফিফা বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে নতুন ফরম্যাটের ক্লাব বিশ্বকাপ শুরু করেছে এবার। সংস্থার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছিলেন, ‘এটা হবে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় উৎসব।’ কিসের কী! সব তো মনে হচ্ছে ফাঁকা বুলি!
তো এত ফাঁকা গ্যালারির কারণ কী? প্রথমত, টিকিটের দামে ফিফার ‘লুটেরা’ নীতি। ফিফা হয়তো শুরুতে ভেবেছিল, আমেরিকানরা তো টাকা খরচ করতে ভালোবাসে, আর এটা তো বিশ্বকাপ! তাই গত বছরের ডিসেম্বরে যখন প্রথম টিকিট ছাড়া হলো, উদ্বোধনী ম্যাচের সবচেয়ে সস্তা টিকিটের দাম ছিল ২২৩ ডলার (প্রায় ২৫ হাজার টাকা)!
সাধারণ গ্রুপ ম্যাচের টিকিটও ১০০ ডলারের ওপর। এর সঙ্গে খাবার, পানীয়, পার্কিং—সব মিলিয়ে এক ম্যাচ দেখতে যে খরচ দাঁড়ায়, সেটা হিসাব করে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল–সমর্থকদের সংগঠন ইনডিপেনডেন্ট সাপোর্টার্স কাউন্সিল তো সরাসরি বলে দিয়েছিল, ‘এটা ফুটবল-ভক্তদের শোষণের নামান্তর!’
এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর অবশ্য ফিফার টনক নড়েছে। বিক্রিবাট্টা একদমই না হওয়ায় তারা টিকিটের দাম কমিয়েছে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর মধ্যে ৩৩টির টিকিটের দাম ২৫ শতাংশের বেশি কমানো হয়েছে। মে মাসের শেষের দিকে, ৪৮টি গ্রুপ ম্যাচের ২৬টির টিকিট ৫০ ডলারের কমে পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু তত দিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে! উৎসাহ কমে গেছে দর্শকের।
আরেকটা কারণ, বেছে বেছে সব বড় স্টেডিয়ামে খেলা ফেলা। ইয়াহু স্পোর্টসের এক প্রতিবেদন বলছে, এ ক্ষেত্রে ফিফা তার আমেরিকান প্রতিনিধিদের পরামর্শ কানে নেয়নি। তাঁরা ছোট স্টেডিয়ামে খেলা আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেখানে ধারণক্ষমতা কম হলেও গ্যালারি ভরা থাকত। কিন্তু ফিফা বেছে নিয়েছে বিশাল বিশাল আমেরিকান ফুটবল স্টেডিয়াম, যার অনেকগুলোর ধারণক্ষমতা ৭০-৮০ হাজার। আর ৮০ হাজার আসনের স্টেডিয়ামে যদি মাত্র ২০ হাজার দর্শক হয়, গ্যালারি তো ফাঁকা মনে হবেই।
ক্লাব বিশ্বকাপের টিকিটের দাম বেশি হওয়ায় মানুষ খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন নাছবি: ফিফা
পরের কারণটা হচ্ছে ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে ফিফার প্রচারণার অভাব আর ভুলভাল বার্তা। ফিফা এই টুর্নামেন্টের প্রচার ঠিকঠাক করেনি। ঠাসা সূচির মাঝে এমন একটা বড় টুর্নামেন্টে খেলতে না চেয়ে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, সৌদি আরবের আর্থিক সমর্থনে একটি সম্প্রচার চুক্তি করে ফিফা যখন এই টুর্নামেন্ট শুরু করল, তখন তাদের কাজ ছিল সাধারণ মানুষকে বোঝানো, টুর্নামেন্টটা কেন গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু তাদের মূল কৌশল কী ছিল? একটি ঝলমলে ট্রফি বানানো আর সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর কিছু চটকদার বক্তব্য। ইনফান্তিনো বারবার একই কথা বলে গেছেন, এই ক্লাব বিশ্বকাপ হবে ‘ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় ও সেরা টুর্নামেন্ট’, ‘বিশ্বের সেরা ৩২টি ক্লাব আর সেরা খেলোয়াড়েরা খেলবে’, ‘২০–৪০ লাখ দর্শক আমেরিকায় আসবে’ এবং ‘৪০০-৫০০ কোটি দর্শক ঘরে বসে দেখবে’।
দল: ৩২ ▏ভেন্যু: ১২ ▏গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ম্যাচ হয়েছে ১২টি ▏গ্রুপ পর্ব শেষ: ২৬ জুন ▏শেষ ষোলো পর্ব: ২৮ জুন থেকে ১ জুলাই ▏কোয়ার্টার ফাইনাল: ৪ থেকে ৫ জুলাই ▏সেমিফাইনাল: ৮ থেকে ৯ জুলাই ▏ফাইনাল: ১৩ জুলাই ▏
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা একটা প্রীতি টুর্নামেন্টের চেয়ে বেশি কিছু, তা মনে হয় না ফিফা ক্লাবগুলোকে বোঝাতে পেরেছে, পারেনি দর্শকদেরও বোঝাতে।
এত কিছুর পরও যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে খেলা দেখতে আগ্রহী ছিলেন, তাঁদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া ভিসা নীতির কারণে। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে এই টুর্নামেন্ট নিয়ে বেশ উন্মাদনা আছে।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন অনেক দেশের নাগরিকদেরই ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন বেশ কড়া নীতি নিয়েছে। মিসরের কায়রোর ২৮ বছর বয়সী গামাল হোসনি যেমন বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, তিনি তাঁর প্রিয় ক্লাব আল আহলির খেলা দেখতে চেয়েছিলেন। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আবেদন করেছিলেন এবং ১৮৫ ডলার ফি–ও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আবেদন বাতিল হয়ে যায়।
=
আবার শুধু খেলা দেখতে আমেরিকায় গিয়ে বেশ কিছুদিন থাকা-খাওয়ার যে খরচ, অনেকের কাছে সেটা বেশি মনে হয়েছে। ফলে বিদেশি দর্শকের উপস্থিতি অনেকটাই কমে গেছে।
আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল বিশ্বকাপে খেলেছে, বিশ্বকাপ আয়োজনও করেছে, কিন্তু ওটা ঠিক ফুটবলপ্রেমী দেশ নয়। ফলে সেখানকার ফুটবল দর্শকেরা হয়তো চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি, রিয়াল মাদ্রিদ চেনেন, কিন্তু বোতাফোগো, এসপেরান্স তিউনিস বা উলসান এইচডি—এসব ক্লাবের নাম তাঁদের কাছে একদম অচেনা। যে দল আপনি চেনেনই না, তাদের খেলা দেখতে কেন মাঠে যাবেন বা টেলিভিশনের সামনে বসবেন।
আবার ফিফা খেলাগুলো ফেলেছেও অদ্ভুত সময়ে। আটলান্টা, নিউ জার্সি বা সিয়াটলে ম্যাচের সময় ছিল বেলা ৩টা বা দুপুরের ১২টা, তা–ও আবার সপ্তাহের কর্মদিবসে! টেলিভিশনের বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শকদের ধরতে এ রকম সময়সূচি ঠিক করেছে ফিফা। কিন্তু স্থানীয় দর্শকেরা মাঠে গিয়ে খেলা দেখার জন্য এটা মোটেও ভালো সময় নয়।
যুক্তরাষ্ট্রবাসীর ব্যস্ততার দিনে ভরদুপুরে হচ্ছে ক্লাব বিশ্বকাপের ম্যাচ। ফলে গ্যালারি এমন খাঁ খাঁ করছেছবি: এক্স
সব মিলিয়েই এমন খাঁ খাঁ গ্যালারি। যেটা দেখেই কি না ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক ডিফেন্ডার ড্যানি মিলস এ টুর্নামেন্টকে ‘অর্থহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথা, ‘আমি বুঝি না এর (ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ) কী মূল্য আছে। অকল্যান্ড সিটির মতো ছোট ক্লাবের জন্য এটা হয়তো একটা দারুণ অভিজ্ঞতা, কিন্তু পিএসজি, রিয়াল মাদ্রিদ বা ম্যানচেস্টার সিটির মতো ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবের খেলোয়াড়েরা কি তাদের ক্যারিয়ারের শেষে এই ক্লাব বিশ্বকাপ জেতার জন্য সত্যিই গর্বিত হবে? এটা আসলে ফিফার টাকা বানানোর জন্য একটি বানানো টুর্নামেন্ট, আর কিছু নয়।’
তারপরও ফিফা খুব একটা হতাশ নয় বলেই মনে হচ্ছে। তাঁদের আশাবাদী হওয়ার একটা কারণ সম্ভবত ১৫ জুন লস অ্যাঞ্জেলেসের প্যাসাডেনায় হওয়া পিএসজি-আতলেতিকো মাদ্রিদের ম্যাচটি, যা দেখতে মাঠে গিয়েছিলেন ৮০ হাজারের বেশি দর্শক।
পিএসজি–আতলেতিকো মাদ্রিদ ম্যাচে ৮০ হাজারের বেশি দর্শক হয়েছিলছবি: ফিফা
গত মঙ্গলবার ফিফা এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘টুর্নামেন্টের প্রথম আটটি ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে গেছেন মোট ৩ লাখ ৪০ হাজার দর্শক, ক্লাব ফুটবলের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার প্রমাণ।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘গ্রুপ পর্বের সবচেয়ে বেশি টিকিট বিক্রি হওয়া পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটি এখনো বাকি।’
গ্রুপ পর্বের পর শেষ ষোলো, যেখানে হয়তো ইউরোপের বড় দলগুলোই টিকে থাকবে। তারপর কোয়ার্টার ফাইনাল, সেফিফাইনাল ও ফাইনাল। ফিফার এই ‘অর্থহীন’ টুর্নামেন্ট বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আসলে সেই বড় ক্লাবগুলোকেই নিতে হবে।